Monday, July 22, 2013

অসমাপ্ত আত্মজীবনী রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস, অতৃপ্ত তৃষ্ণা : বঙ্গবন্ধুর লেখা প্রথম বই

অসমাপ্ত আত্মজীবনী রুদ্ধশ্বাস ইতিহাস, অতৃপ্ত তৃষ্ণা : বঙ্গবন্ধুর লেখা প্রথম বই

মোরসালিন মিজান ॥ অসমাপ্ত আত্মজীবনী। এমন শিরোনামই বলে দেয় গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ। এতে পুরোপুরি নেই শেখ মুজিব। কিন্তু যেটুকু আছেন, সেটুকু তাঁর নিজ কলমে। এখানেই ব্যতিক্রম। এই এখানে নতুন করে কথা বলে ইতিহাস। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রকাশিত হন তাঁর নিজ বয়ানে। ইতিহাসের বরপুত্রের এ বয়ান সোমবার প্রকাশিত হয়েছে বই আকারে। শিরোনাম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বা ‘দি আনফিনিশড মেময়ারস।’ দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড ইউপিএল প্রকাশিত বইটি নিয়ে দারুণ কৌতূহলী এখন পাঠক। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত এবং পাকিস্তান থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে ‘দি আনফিনিশড মেময়ারস।’ ভারতে বইটি প্রকাশ করেছে সেখানকার খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া। পাকিস্তানে প্রকাশ করেছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস পাকিস্তান। আরও কয়েকটি ভাষায় বইটি প্রকাশের কাজ চলছে। জানা যায়, ২০০৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা চারটি খাতা আকস্মিকভাবে হাতে পান তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা। বহু পুরনো এসব খাতার পাতায় পাতায় ক্ষত। কোন কোন লেখা অস্পষ্ট। এর পরও গভীর কৌতূহল নিয়ে পাঠ করা করেন তিনি। আর তখনই জানা যায়, এটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী! ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় পাণ্ডুলিপি তৈরি শুরু করেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু সীমাহীন বেদনার যে লেখাটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। তবে অসমাপ্ত হলেও পা-ুলিপিটির ইতিহাস মূল্য অনেক। সাহিত্য মূল্য অপরিসীম। এসব কারণে এটি বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। বইটিতে শেখ মুজিবের আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, শিক্ষাজীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ের ধারাবাহিক বর্ণনা পাওয়া যায় এ বইতে।

বঙ্গবন্ধুর লেখায় ওঠে এসেছে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশ ভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের কথা তুলে ধরেছেন শেখ মুজিব। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন ইত্যাদি ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে বইতে এসেছে। বিস্তৃতভাবে আছে পাকিস্তানী অপশাসনের কথা। এভাবে শেখ মুজিবের ব্যক্তি জীবন ইতিহাসের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বইয়ের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর স্বহস্তে লেখা নোটবুকের একটি পাতা। এতে ইংরেজীতে তিনি লিখেছেন একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসাবে যা কিছু বাঙালীদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। আত্মজীবনীর অদ্ভুত সুন্দর শুরু। সরল স্বীকারোক্তি করে মুজিব লিখেছেন বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ’। সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোন কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য আমরা সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ এ ভূমিকা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জায়গাটিকে পরিষ্কার করে। শুরুতেই প্রচ- বিনয় নিয়ে প্রকাশিত হন মহান নেতা। একইসঙ্গে আবারও জানার সুযোগ হয়, অন্য অনেক কাজের মতো জীবনী লেখার কাজটিতেও মূল অনুপ্রেরণা ছিল বেগম মুজিবের। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় রেণু এই জীবনী লেখার জন্য জেলগেটে খাতা কিনে দিয়ে এসেছিলেন। সেসব খাতায় আত্মজীবনী লিখেছেন মুজিব। বইয়ের শুরুতে নিজের বংশ পরিচয়। শেখ বংশের পূর্ব পুরুষদের অনেকের কথা উল্লেখ করেন তিনি। এ বংশের প্রতিপত্তির কথা অনুমান করা যায় যখন তিনি লিখেন আমাদের বাড়ির দালানগুলোর বয়স দুইশত বছরেরও বেশি। অবশ্য কোন রকমের আক্ষেপ ছাড়াই মুজিব জানান, শেখ বংশ ধন সম্পত্তি ধরে রাখতে পারেনি। তবে পুরনো ইতিহাস বলে গর্ব করত। নিজের জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে মুজিব জানান, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ প্রতিষ্ঠিত ইংরেজী স্কুলে শুরু হয় শিক্ষা জীবন। তবে শান্ত শিষ্টটি নয় বরং খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলেন বলে আত্মজীবনীতে জানান তিনি। খেলাধুলা করতেন। গান গাইতেন। শৈশবে দুইবার অসুস্থও হন তিনি। তাই চার বছর লেখা পড়া বন্ধ ছিল। অপারেশনের পর ১৯৩৬ সাল থেকে তিনি চশমা পরা শুরু করেন। শৈশবে তাঁর মানস গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায় তাঁর লেখা থেকে। মুজিব লেখেন আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। তখন আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম। প্রতিবাদী চরিত্রটিও শৈশব থেকেই ছিল। আর তাই বালক বয়সেই জেলবাস কী বস্তু জেনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। মজার তথ্য দিয়ে আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন জীবনের প্রথম কারাবাসের সময় মহিলা ওয়ার্ডে ছিলাম। কারাগারে মহিলা না থাকায় এমন ব্যবস্থা! ইতিহাসের বরপুত্র স্কুলে পড়ার সময় থেকেই যুক্ত হয়ে পড়েন রাজনীতির সঙ্গে। এটি সকলেরই জানা। তবে বইতে পাওয়া যায় ধারাবাহিক ও নিখুঁত একটি বর্ণনা। ১৯৪১ সালে মুজিব যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী তখন রাজনীতির সঙ্গে দিন রাত কাটে। শেখ মুজিবের ভাষায় তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। সেই সময়ের উপলব্ধির কথা তুলে ধরে তিনি লেখেন পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নেই। মুজিবের ঘটনাবহুল সময় কাটে কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে। এ সময় জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ করে নেন তিনি। ইতোমধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহ আদায় করে নেন তরুণ কর্মী শেখ মুজিব। তাঁর সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথাও আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেন তিনি। দু’জনের সম্পর্ক বর্ণনা করেন চমৎকারভাবে। জানান, একবার সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কথাকাটাকাটিও হয়ে যায় তাঁর। তবে শেখ মুজিবকে সবচেয়ে ভালবাসতেন সোহরাওয়ার্দীই। তাই ফের কাছে ডেকেছেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। ১৯৪৩ সালে শেখ মুজিব যখন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য তখন শুরু হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় নিজের তৎপরতা সম্পর্কে বইতে লিখেছেন তরুণ নেতা শেখ মুজিব। বিহার ও কলকাতার দাঙ্গার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্ণনা করেছেন দেশভাগের ইতিহাস। এই ধারাবাহিকতায় এসেছে পাকিস্তান আমল। বাঙালীর মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে নানা বৈষম্যমূলক নীতির উল্লেখ করেছেন। বইতে তাঁর সময়ের বড় বড় রাজনীতিকদের প্রসঙ্গ এসেছে। এক জায়গায় মওলানা ভাসানী সম্পর্কে তিনি লিখেছেনÑ মওলানা ভাসানীর খেলা বোঝা কষ্টকর। তবে পড়তে পড়তে বইটি যখন শেষ হয় তখন একটি দীর্ঘশ্বাস বড় হয়ে ওঠে। মনে হয়, যদি আরও একটু লিখে যেতেন নেতা! যদি ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলনের মুজিবকে পাওয়া যেত! যদি বাঙালীর একমাত্র মুক্তিদাতা জাতির জনককে পাওয়া যেত! না সেটি হয়নি। তাই তৃষ্ণাটা থেকেই যায়। ৩২৯ পৃষ্ঠার বইতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। পা-ুলিপির বেশ কয়েকটি ছবি তুলে দেয়া হয়েছে।  
  1. জীবনী গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। এই গ্রন্থের পা-ুলিপি হাতে পাওয়ার অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন আমি ২১ আগস্ট মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছি। মনে হয় যেন নতুন জন্ম হয়েছে। আর সেই সময় আমার হাতে এলো আব্বার হাতের লেখা এই অমূল্য আত্মজীবনীর চারখানা খাতা! আমার ফুফাতো ভাই বাংলার বাণী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে এগুলো পাওয়া যায়। সম্ভবত আব্বা শেখ মণিকে টাইপ করতে দিয়েছিলেন, আত্মজীবনী ছাপাবেন এই চিন্তা করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনিও শাহাদাৎবরণ করায় তা করতে পারেননি। পরের লেখাগুলো আরও আবেগাপ্লুত করবে পাঠককে। শেখ হাসিনা এ অংশে লিখেছেন খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। তথ্যটা জেনে পাঠক হয়ত অবাক হবেন, এ বইয়ের ভূমিকা শেখ হাসিনা লিখেছেন কারাবন্দী অবস্থাতেই!Kazi NazrulShiplu RoyAyub Khan and 11 others like this.

No comments:

Post a Comment